বাইবেলের দৃষ্টিভঙ্গি
একাকিত্বের মূল্য
এক সময় যীশু “বিরলে প্রার্থনা করিবার নিমিত্ত পর্ব্বতে উঠিলেন। সন্ধ্যা হইলে তিনি সেই স্থানে একাকী থাকিলেন।” (মথি ১৪:২৩) আরেকবার “প্রভাত হইলে তিনি বাহির হইয়া কোন নির্জ্জন স্থানে গমন করিলেন।” (লূক ৪:৪২) এই শাস্ত্রপদগুলি সাক্ষ্য দেয় যে যীশু খ্রীষ্ট কখনও কখনও একাকিত্ব খুঁজে নিয়েছিলেন এবং তিনি একাকী থাকতে চাইতেন।
বাইবেল আরও ব্যক্তিদের উদাহরণ দিয়ে থাকে যারা যীশুর মতো একাকিত্বকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেছিলেন। নিঝুম রাতের প্রহরে গীতরচক তার মহান সৃষ্টিকর্তার মাহাত্ম্যের উপর ধ্যান করেছিলেন। আর যীশু খ্রীষ্ট, যোহন বাপ্তাইজকের মৃত্যুসংবাদ শোনার পর, “বিরলে এক নির্জ্জন স্থানে প্রস্থান করিলেন।”—মথি ১৪:১৩; গীতসংহিতা ৬৩:৬.
আজকের, হইচই ও হট্টগোলপূর্ণ আধুনিক জীবনে একাকী থাকার জন্য সময় এসেই পড়ুক বা তা করেই নিতে হোক, একাকিত্বকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হয় না। আপনার কি স্মরণে আছে, আপনি শেষবারের মতো কখন একাকী সময় কাটিয়েছেন? এক বিবাহিত যুবতী মহিলা বলেছিলেন: “আমি আমার জীবনে কখনও একাকী থাকিনি।”
কিন্তু প্রকৃতই কি একাকিত্বের প্রয়োজন রয়েছে? যদি তাই হয়, কিভাবে নির্জন সময়কে কাটানো যেতে পারে যা আমাদের জন্য উপকার ও সুফল নিয়ে আসতে পারে? আর একাকিত্বের সঙ্গে ভারসাম্য রাখার কথা আসে কেন?
একাকিত্ব—জরুরি কেন?
বাইবেল আমাদের বলে যে প্রাচীনকালের ঈশ্বরের আজ্ঞা পালনকারী ব্যক্তি, ইস্হাক একাকী থাকার জন্য “সন্ধ্যাকালে . . . ক্ষেত্রে গিয়াছিলেন।” কেন? বাইবেল উত্তর দেয় “ধ্যান করিতে।” (আদিপুস্তক ২৪:৬৩) একটি অভিধান অনুসারে, ধ্যান করা হল “গভীরভাবে অথবা সাধারণভাবে চিন্তা করা।” এর “অর্থ হল একাগ্র মনোযোগের সঙ্গে ও অনেকখানি সময় ধরে ধ্যান করা।” কেননা ইস্হাক, যিনি খুব শীঘ্র গুরু দায়িত্বগুলি নিতে যাচ্ছিলেন, এই অবিক্ষিপ্ত ধ্যানই তাকে স্পষ্টভাবে চিন্তা করতে, নিজেকে ওই দায়িত্বগুলির জন্য মানসিকভাবে তৈরি করতে ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি বুঝতে সক্ষম করেছিল।
একজন মনোস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ জানান, যে সময়টুকু আমরা ‘একাকী থাকার জন্য বেছে নিই সেই সময় অন্যদের অনুপস্থিতি আমাদের চিন্তাধারাকে সুসংগঠিত করতে ও একাগ্রচিত্তে মনোযোগী হতে সাহায্য করে।’ লোকেদের জিজ্ঞাসা করুন আর তারা আপনাকে বলবেন যে এটি আমাদের সতেজতা দেয়, আমাদের শক্তিশালী করে এবং আমরা স্বাস্থ্যবান থাকতে পারি।
ধ্যানের কাঙ্ক্ষিত ফলাফলগুলি হল সুগভীর ও শান্ত গাম্ভীর্য, বিবেচনাপূর্ণ কথাবার্তা এবং কাজ করতে সাহায্য করে এমন গুণাবলি। আর এর ফলে লোকেদের সঙ্গে ভাল সম্পর্ক গড়ে তোলা যায়। উদাহরণস্বরূপ, একজন ব্যক্তি যিনি ধ্যান করতে শেখেন তিনি এর সঙ্গে সঙ্গে নিরব থাকতেও শেখেন। বেপরোয়াভাবে কথা বলার চেয়ে বরঞ্চ, তিনি তার কথার সম্ভাব্য ফলাফল সম্বন্ধে আগেই চিন্তা করেন। “তুমি কি হঠকারী লোককে দেখিতেছ?” অনুপ্রাণিত বাইবেল লেখক জিজ্ঞাসা করেন। তিনি বলে চলেন: “তাহার অপেক্ষা বরং হীনবুদ্ধির বিষয়ে অধিক আশা আছে।” (হিতোপদেশ ২৯:২০) জিহ্বার এইধরনের অসতর্ক ব্যবহারের প্রতিকার কী? বাইবেল বলে: “ধার্ম্মিকের মন উত্তর করিবার নিমিত্ত চিন্তা করে।”—হিতোপদেশ ১৫:২৮. গীতসংহিতা ৪৯:৩ পদের সঙ্গে তুলনা করুন।
খ্রীষ্টানদের জন্য, একাকী থেকে শান্তভাবে ধ্যান করা আধ্যাত্মিক পরিপক্বতাকে বাড়ানোর একটি জরুরি উপায়। তাই প্রেরিত পৌলের বাক্যগুলি উপযুক্ত: “এ সকল বিষয়ে চিন্তা কর, এ সকলে স্থিতি কর, যেন তোমার উন্নতি সকলের প্রত্যক্ষ হয়।”—১ তীমথিয় ৪:১৫.
ঈশ্বরের নিকটবর্তী হতে একাকিত্বকে ব্যবহার করুন
একজন ইংরেজ গ্রন্থাকার বলেছেন: “একাকিত্বই ঈশ্বরের শ্রবণালয়।” কখনও কখনও, যীশু লোকেদের কাছ থেকে আলাদা হয়ে নিরালায় ঈশ্বরের সান্নিধ্যে থাকা ও তাঁর সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করতেন। বাইবেল এর একটি উদাহরণ দেয়: “অতি প্রত্যূষে, রাত্রি পোহাইবার অনেকক্ষণ পূর্ব্বে, তিনি উঠিয়া বাহিরে গেলেন, এবং নির্জ্জন স্থানে গিয়া তথায় প্রার্থনা করিলেন।”—মার্ক ১:৩৫.
গীতসংহিতায়, ঈশ্বর-বিষয়ক ধ্যান সম্বন্ধে বার বার উল্লেখ করা হয়েছে। যিহোবার উদ্দেশে, রাজা দায়ূদ বলেছিলেন: “তোমার বিষয় ধ্যান করি।” আসফও এই একই কথা বলতে চেয়েছিলেন যখন তিনি বলেন: “আমি তোমার সমস্ত কর্ম্ম ধ্যানও করিব, তোমার ক্রিয়া সকল আলোচনা করিব।” (বাঁকা অক্ষরে মুদ্রণ আমাদের।) (গীতসংহিতা ৬৩:৬; ৭৭:১২) অতএব ঐশিক গুণাবলি এবং আচরণের উপর চিন্তা করা প্রচুর পুরস্কার নিয়ে আসে। এটি ঈশ্বরের প্রতি আমাদের উপলব্ধিবোধ বাড়িয়ে তোলে ও একজন ব্যক্তিকে তাঁর নিকটবর্তী করে।—যাকোব ৪:৮.
ভারসাম্য রাখা প্রয়োজন
অবশ্যই, যখনই একাকিত্বের প্রসঙ্গ আসে সঙ্গে সঙ্গে ভারসাম্য কথাটিও এসে পড়ে আর একাকিত্বে ভারসাম্য থাকা জরুরি। একাকিত্বকে এমন এক জায়গার সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে যেখানে অল্প সময়ের জন্য যাওয়া খুবই আনন্দের হতে পারে কিন্তু সেখানে থাকা খুবই বিপদজনক। নিজেকে অন্যদের কাছ থেকে একেবারে নিঃসঙ্গ করে নেওয়া আমাদের, মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলিকে পূর্ণ করে না যেমন মেলামেশা করা, ভাববিনিময় করা ও ভালবাসা প্রকাশ করা। এছাড়াও, নিঃসঙ্গতার ক্ষেত্র থেকে নির্বুদ্ধিতা ও স্বার্থপরতার আগাছা উৎপন্ন হতে পারে। বাইবেলের প্রবাদবাক্য সতর্ক করে: “যে পৃথক্ হয় সে নিজ অভীষ্ট চেষ্টা করে, এবং সমস্ত বুদ্ধিকৌশলের বিরুদ্ধে উচ্চণ্ড হয়।” (হিতোপদেশ ১৮:১) একাকী থাকায় ভারসাম্য আনতে হলে আমাদের অবশ্যই নিঃসঙ্গতার বিপদগুলি বুঝতে হবে।
যীশু ও বাইবেলের সময়ে অন্যান্য আধ্যাত্মিক ব্যক্তিদের মতো, আজকে খ্রীষ্টানেরা তাদের একাকিত্বের মুহূর্তগুলি অতি মূল্যবান বলে মনে করেন। এটি সত্য যে আমাদের মাথার উপর যখন অনেক দায়িত্ব আর দুনিয়ার দুশ্চিন্তা থাকে তখন একান্তে ধ্যান করার সময় ও সুযোগ খুঁজে নেওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু, অন্য অনেক জরুরি কাজের জন্য যেমন সত্য, আমাদের অবশ্যই “সুযোগ কিনিয়া” নিতে হবে। (ইফিষীয় ৫:১৫, ১৬) তাহলেই, গীতরচকের মতো আমরাও বলতে পারব: “আমার মুখের বাক্য ও আমার চিত্তের ধ্যান তোমার দৃষ্টিতে গ্রাহ্য হউক, হে সদাপ্রভু।”—গীতসংহিতা ১৯:১৪.