দারিয়াবস একজন ন্যায়পরায়ণ রাজা
একজন বিখ্যাত রাজা নিজের নির্মাণ প্রকল্প সম্বন্ধে গর্ব করে বলেছিলেন: “আমি বাবিলনের পশ্চিম সীমান্তে একটি মজবুত প্রাচীর নির্মাণ করেছি। একটি পরিখা খনন করেছি . . . আমি বিটুমিন ও ইটের তৈরি একটি শক্তিশালী পর্বত সমান প্রাচীর নির্মাণ করেছি যা চিরস্থায়ী।” হ্যাঁ, বাবলনীয় রাজা নবূখদ্নিৎসর এক বৃহৎ নির্মাণ কাজ করেছিলেন এবং তার সাম্রাজ্যের রাজধানীকে সুরক্ষিত করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন। কিন্তু বাবিলন শহরকে তিনি যতটা অজেয় বলে মনে করেছিলেন, বাস্তবে সেটি ততটা হয়নি।
সাধারণ কাল পূর্ব ৫৩৯ সালের ৫ই অক্টোবরই তা প্রমাণিত হয়। মাদীয় সৈন্যদের সাহায্যে পারস্য শাসক কোরস ২য়, বাবিলন জয় করেছিলেন এবং কল্দীয় রাজা বেল্শৎসরকে হত্যা করেছিলেন। এই নতুন বিজিত শহরের প্রধান শাসক এখন কে হবেন? ঈশ্বরের ভাববাদী দানিয়েল, যিনি শহরটির পতনের সময় সেখানেই ছিলেন, তিনি লিখেছিলেন: “মাদীয় দারিয়াবস রাজ্য প্রাপ্ত হন; তখন তাঁহার প্রায় বাষট্টি বৎসর বয়স হইয়াছিল।”—দানিয়েল ৫:৩০, ৩১.
দারিয়াবস কে ছিলেন? তিনি কোন্ ধরনের শাসক হিসাবে প্রমাণিত হয়েছিলেন? ভাববাদী দানিয়েলের সঙ্গে তিনি কেমন আচরণ করেছিলেন, যিনি ৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে বাবিলনে নির্বাসিত ছিলেন?
সংক্ষিপ্ত ইতিহাস সহ এক রাজা
মাদীয় দারিয়াবস সম্বন্ধে খুবই সংক্ষিপ্ত ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়। মাদীয়রা মূলত কোন লিখিত নথিই রাখেনি। এছাড়াও, মধ্য প্রাচ্যে মাটি খুঁড়ে তোলা লক্ষ লক্ষ কীলকাকার লিপিফলক অনেক কিছু বাদ দিয়ে অসম্পূর্ণ ইতিহাসকে তুলে ধরে। প্রাচীন যুগের অন্যান্য লিপি এখনও অস্তিত্বে আছে কিন্তু সেগুলির সংখ্যা খুবই কম এবং দারিয়াবসের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ঘটনাগুলি থেকে প্রায় এক শতাব্দী বা তারও বেশি সময়ের ব্যবধান বিদ্যমান।
তাসত্ত্বেও, প্রমাণগুলি ইঙ্গিত করে যে মাদীয় রাজ্যের রাজধানী, একবাটানা শহর জয় করার পর পারস্য শাসক কোরস ২য়, মাদীয়দের আনুগত্য অর্জন করতে পেরেছিলেন। তারপর, মাদীয় ও পারসীকরা তার নেতৃত্বাধীনে এক হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। তাদের সম্পর্কের বিষয়ে, লেখক রবার্ট কলিন্স তার মাদীয় ও পারসীকেরা (ইংরাজি) নামক বইয়ে মন্তব্য করেন: “পদমর্যাদায় মাদীয় ও পারসীকেরা সমান ছিলেন এবং তাদের মধ্যে শান্তি ছিল। মাদীয়দের প্রায়ই বড় বড় সরকারী পদগুলিতে নিযুক্ত করা হত এবং তারা এবং তারা পারসীক সৈন্যদলে নেতৃত্বও দিতেন। বিদেশীরা বুঝতে পারতেন না যে মাদীয় ও পারসীকদের মধ্যে কারা বিজয়ী ও কারা বিজিত।” এভাবে মাদীয় পারসীক সাম্রাজ্য গঠন করার জন্য মাদীয়রা, পারসীকদের সঙ্গে সন্ধি করেছিলেন।—দানিয়েল ৫:২৮; ৮:৩, ৪, ২০.
বাবিলনকে জয় করার ক্ষেত্রে মাদীয়রা নিশ্চয়ই এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। শাস্ত্র “মাদীয় বংশজাত অহশ্বেরশের পুত্ত্র . . . দারিয়াবস”-কে মাদীয় পারসীক সাম্রাজ্যের প্রধান শাসক হিসাবে উপস্থাপন করে, যার সঙ্গে পরবর্তী সময়ে বাবিলন যুক্ত হয়েছিল। (দানিয়েল ৯:১) তার রাজকীয় ক্ষমতা তাকে সংবিধান স্থির করার অধিকার দিয়েছিল যা “মাদীয়দের ও পারসীকদের অলোপ্য ব্যবস্থানুসারে . . . অপরিবর্ত্তনীয়” ছিল। (দানিয়েল ৬:৮) বাইবেল দারিয়াবস সম্বন্ধে যা বলে তা আমাদের তার ব্যক্তিত্ব, সেইসঙ্গে তার বিষয়ে কেন ঐতিহাসিক কোন তথ্যই নেই এর অকাট্য কারণ সম্বন্ধে আভাস দেয়।
দানিয়েলের প্রতি অনুগ্রহ দেখানো হয়
বাইবেল বলে যে দারিয়াবস বাবিলনের ক্ষমতা লাভ করার সঙ্গে সঙ্গেই “রাজ্যের সর্ব্বস্থানে রাজ্যের উপর এক শত বিংশতি জন ক্ষিতিপাল” নিযুক্ত করেছিলেন “এবং তাঁহাদের উপরে তিন জন অধ্যক্ষকে নিযুক্ত করেন; সেই তিন জনের মধ্যে দানিয়েল এক জন ছিলেন।” (দানিয়েল ৬:১, ২) কিন্তু, দানিয়েল উচ্চ পদ পাওয়ায় অন্যান্য অধ্যক্ষেরা অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। নিঃসন্দেহে, তার সততা দুর্নীতিকে দমন করতে চেয়েছিল আর এই কারণেই তারা ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন। উচ্চপদস্থ অধ্যক্ষদের মধ্যে অবশ্যই ঈর্ষা কাজ করেছিল, কারণ রাজা দানিয়েলের প্রতি অনুগ্রহ দেখাতেন এবং তাকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর জন্য চিন্তা করছিলেন।
এই চিন্তা যাতে বাস্তবায়িত না হয় তাই দুইজন অধ্যক্ষ এবং ক্ষিতিপালগণ একটি বৈধ ফন্দি আঁটেন। তারা রাজার কাছে যান এবং স্বাক্ষর করার জন্য একটি অনুশাসন পেশ করেন যেখানে ৩০ দিন পর্যন্ত দারিয়াবস ছাড়া অন্য “কোন দেবতার কিম্বা মানুষের কাছে প্রার্থনা” করাকে নিষেধ করা হয়েছিল। তারা প্রস্তাব দিয়েছিলেন, কেউ অমান্য করলে তাকে সিংহের গর্তে নিক্ষেপ করা হবে। দারিয়াবসকে এই কথা বিশ্বাস করতে প্ররোচিত করা হয়েছিল যে এই অনুশাসন সকল উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা পছন্দ করবেন আর প্রস্তাবটিকে আপাতদৃষ্টিতে রাজার প্রতি তাদের আনুগত্যের এক প্রকাশ বলে মনে হয়েছিল।—দানিয়েল ৬:১-৩, ৬-৮.
দারিয়াবস এই সংবিধানে স্বাক্ষর করেছিলেন এবং শীঘ্রই এর ফলাফল দেখা গিয়েছিল। দানিয়েল ছিলেন এই অনুশাসনের প্রথম অমান্যকারী কারণ তিনি যিহোবা ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনায় রত ছিলেন। (প্রেরিত ৫:২৯ পদের সঙ্গে তুলনা করুন।) এই অপরিবর্তনীয় সংবিধানকে যে কোন মতে এড়ানোর জন্য রাজার আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, বিশ্বস্ত দানিয়েলকে সিংহের গর্তে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। দারিয়াবস দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন যে দানিয়েলের ঈশ্বর তাঁর ভাববাদীকে জীবিত রাখার ক্ষমতা রাখেন।—দানিয়েল ৬:৯-১৭.
অনিদ্রা আর উপবাসে রাতটি কাটানোর পর, দারিয়াবস অবিলম্বে সিংহের গর্তের কাছে গিয়েছিলেন। দানিয়েলকে জীবিত ও অক্ষত পেয়ে কী আনন্দিতই না তিনি হয়েছিলেন! সমুচিত শাস্তি হিসাবে রাজা অবিলম্বে দানিয়েলের দোষারোপকারী ও তাদের পরিবারদের সিংহের গর্তে নিক্ষেপ করেছিলেন। এছাড়াও তিনি এক আদেশ জারি করেছিলেন যে ‘তার রাজ্যের অধীন সর্ব্বস্থানে লোকেরা দানিয়েলের ঈশ্বরের সাক্ষাতে কম্পমান হউক ও ভয় করুক।’—দানিয়েল ৬:১৮-২৭.
স্পষ্টতই দারিয়াবস, দানিয়েলের ঈশ্বর ও তার ধর্মকে সম্মান করতেন এবং ন্যায়বিচার করার একান্ত ইচ্ছা তার ছিল। কিন্তু, দানিয়েলের দোষারোপকারীদের শাস্তিদান নিশ্চয়ই অবশিষ্ট অন্যান্য অধ্যক্ষদের বিদ্বেষকে জাগিয়ে তুলেছিল। এছাড়াও, সমস্ত রাজ্যে ‘দানিয়েলের ঈশ্বরকে ভয়’ করার জন্য দারিয়াবসের ঘোষণাও নিশ্চয়ই ক্ষমতাবান বাবিলনীয় যাজকদের মধ্যে অনেক বিরক্তির উদ্রেগ করেছিল। যেহেতু অধ্যাপকেরা এই ঘটনাগুলির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন, তাই যদি দারিয়াবস সম্বন্ধীয় তথ্যগুলিকে ধ্বংস করে দেওয়ার জন্য জাগতিক নথিগুলিকে পরিবর্তিত করা হয়, তাহলে তা কোন আশ্চর্যের বিষয় হবে না। কিন্তু, দানিয়েলের বইয়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ, দারিয়াবসকে এক সৎ ও ন্যায়পরায়ণ রাজা হিসাবে তুলে ধরে।