কোমাল ভির্দি | জীবনকাহিনি
“আমি সবসময় চেয়েছিলাম যেন কারো সঙ্গে কোনো অবিচার না হয়”
১৯৭৩ সালের আগস্ট মাসে আমি ও আমার দুই বোন ইংল্যান্ডের টুইকেনহ্যাম শহরে এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিই। সেই সম্মেলনের মূলভাব ছিল, ‘ঈশ্বরীয় বিজয়।’ সেখানে ভাই এডউইন স্কিনারের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়, যিনি ১৯২৬ সাল থেকে ভারতে একজন মিশনারি হিসেবে সেবা করছিলেন। তিনি যখন জানতে পারেন, আমরা পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বলি, তখন তিনি আমাদের বলেন, “তোমরা এখানে কী করছ? তোমাদের তো ভারতে থাকা উচিত!” তাই আমরা ভারতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। আর এভাবে আমি পাঞ্জাবি ভাষা জানে এমন ব্যক্তিদের কাছে সুসমাচার জানানোর ক্ষেত্রে সাহায্য করতে থাকি। তবে, আসুন আমি আপনাদের বলি যে, সেই আলোচনা শুরু হওয়ার আগে কী কী ঘটেছিল।
আমি ১৯৫১ সালে কেনিয়ার নাইরোবি শহরে জন্মগ্রহণ করি। আমার বাবা-মা ভারতীয় ছিলেন এবং শিখ ধর্মে বিশ্বাস করতেন। আমার বাবার দুই স্ত্রী ছিল। প্রথম স্ত্রী আমার মা ছিলেন এবং তিনি বাবাকে দ্বিতীয় বার বিয়ে করতে বাধা দিতে পারেননি। আমরা মায়ের এবং সৎ মায়ের সন্তানেরা প্রায়ই একইসময়ে জন্মগ্রহণ করেছিল, তাই আমি আমার নিজের এবং সৎ ভাই-বোনদের মাঝে বড়ো হয়ে উঠি। আমরা জ্যাঠারও একটি ছেলে ছিল, সেইজন্য আমরা সব মিলিয়ে পরিবারে সাত জন সন্তান ছিলাম। ১৯৬৪ সালে যখন আমার বয়স ১৩ বছর ছিল, তখন আমার বাবা মারা যান।
আমি চেয়েছিলাম যেন সবাই ন্যায়বিচার পায়
আমি যখন বড়ো হই, তখন আমি আমার চোখের সামনে অনেক লড়াই, ঝগড়া ও ভেদাভেদ হতে দেখি। পরে, আমি যখন বাইবেল থেকে লেয়া ও রাহেলের বিবরণ পড়ি, তখন আমার মনে হয়েছিল, আমাদের পরিবারের কাহিনি অনেকটা একইরকম। আমাদের পরিবারের লোকেরা কেনিয়ার চাকরদের সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করত কারণ আমাদের শেখানো হয়েছিল, তারা আমাদের থেকে নীচু শ্রেণির লোক। আমার বাবা চেয়েছিলেন আমরা যেন আমাদের ইউরোপীয় প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করি কারণ বাবা বলতেন, তাদের কাছ থেকে আমরা অনেক কিছু শিখতে পারি। কিন্তু, বাবা আফ্রিকার লোকদের বিষয় বলতেন, আমরা যেন তাদের দূরে থাকি কারণ তাদের কাছ থেকে আমরা কিছুই শিখতে পারব না। আর আমাদের এও বলা হত, আমরা যেন পাকিস্তানের লোকদের সঙ্গে কোনোরকম সম্পর্ক না রাখি কারণ তারা আমাদের শত্রু। আমি সবসময় চেয়েছিলাম, কারো সঙ্গে যেন কখনো কোনো অবিচার ও ভেদাভেদ না হয়, তাই আমার কাছে বাবার চিন্তাধারা সঠিক বলে মনে হয়নি।
শিখ ধর্ম শুরু হয়েছিল প্রায় ১৫০০ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে এবং গুরু নানক এটা শুরু করেছিলেন। আমি গুরু নানকের শিক্ষাগুলো গ্রহণ করি কারণ আমরা কাছে সেটা সঠিক বলে মনে হয়েছিল। সেগুলোর মধ্যে একটা শিক্ষা ছিল, একজনই সত্য ঈশ্বর আছেন। তবে, আমি যখন শিখ ধর্মের লোকদের অন্যায় করতে দেখি, তখন আমি চিন্তায় পড়ে যাই। আমার মনে হয়েছিল, কোথাও যেন একটা গণ্ডগোল আছে।
আরও কিছু বিষয় ছিল, যেগুলো আমি বুঝতে পারতাম না। যেমন, শিখ ধর্ম মাত্র ৫০০ বছর আগে শুরু হয়েছিল। তাই আমি চিন্তা করতাম, ‘এর আগে লোকেরা কী বিশ্বাস করত? যখন এই পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল, তখন লোকেরা ঈশ্বরের উপাসনা কীভাবে করত?’ আর আমাদের বাড়ির ক্যালেন্ডারে ১০ জন শিখ গুরুর ছবি ছিল। তাদের বিষয়েও আমি চিন্তা করতাম, ‘কীভাবে আমরা বুঝতে পারব, তারা দেখতে কেমন ছিল? আর যখন গুরুরাই আমাদের শিখিয়েছে, একজনই ঈশ্বর রয়েছেন এবং তাঁকেই উপাসনা করা উচিত, তা হলে আমরা কেন সেই গুরুদের ছবির সামনে মাথা নীচু করব?’
১৯৬৫ সালে আমি আমার পরিবারের সঙ্গে ভারতে চলে আসি। তখন আমার বয়স ১৪ বছর ছিল। আমাদের কাছে বেশি টাকাপয়সা ছিল না, তাই সেখানে আমাদের অনেক সমস্যার মধ্যে পড়তে হয়। এক বছর পর আমরা চিন্তা করি, আমরা ইংল্যান্ডে গিয়ে বাস করব। কিন্তু, পুরো পরিবার একসঙ্গে যাওয়ার মতো যথেষ্ট টাকাপয়সা আমাদের ছিল না। তাই, আমরা দু-জন করে ইংল্যান্ডের লেস্টার শহরে যাই এবং সেখানে থাকতে শুরু করি।
১৬ বছর বয়সে আমি ছোটোখাটো কাজ করতে শুরু করি। তখনও আমরা পড়াশোনা শেষ হয়নি, তাই আমি নাইট স্কুলে যেতে শুরু করি। কাজের জায়গায় আমি প্রচুর ভেদাভেদ হতে দেখি। যেমন, অন্য দেশ থেকে আসা লোকদের তুলনায় শেতাঙ্গ লোকদের বেশি বেতন দেওয়া হত। আমি এটা সহ্য করতে পারিনি, তাই আমি যুবকবয়সিদের নিয়ে গঠিত একটা শ্রমিক দলে যোগ দিই। আমি অন্য দেশে থেকে আসা কিছু মহিলাকে একত্রিত করি এবং সবাই যাতে সমান বেতন পায়, সেই নিয়ে আন্দোলন করি। আমি শুধু এটাই চেয়েছিলাম যেন সবাই ন্যায়বিচার পায়।
আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পাই
১৯৬৮ সালে দু-জন যিহোবার সাক্ষি আমার ঘরের দরজায় কড়া নাড়ে। তখনই আমার প্রথম বার সাক্ষিদের সঙ্গে দেখা হয়। তারা বলে, যখন ঈশ্বরের রাজ্য আসবে, তখন কারো প্রতি কোনো ভেদাভেদ করা হবে না। এই কথাটা শুনে আমার খুব ভালো লাগে। এরপর, তাদের মধ্যে একজন সাক্ষি তার স্ত্রীর সঙ্গে আমার বাড়িতে আবারও আসেন। সেইসময় আমি ও আমার বোন জেসবিন্দর এবং আমার সৎ বোন চানি তাদের সঙ্গে বাইবেল অধ্যয়ন করতে শুরু করি। আমরা মাত্র ছয় পাঠ পর্যন্ত আলোচনা করেছি, কিন্তু এরই মধ্যে আমরা নিশ্চিত হয়ে যাই যে, যিহোবাই হলেন একমাত্র সত্যময় ঈশ্বর। সেই ঈশ্বরই বাইবেল লিখিয়েছেন এবং একমাত্র তাঁর রাজ্যে সবাই ন্যায়বিচার লাভ করবে।
কিন্তু, আমার পরিবার আমাদের বিরোধিতা করতে শুরু করে। বাবা মারা যাওয়ার পর আমার সৎ ভাই পরিবারের মস্তক হয়ে ওঠে। আমার সৎ মা তার কান ভাঙাতেন এবং মায়ের কথা শুনে আমার সৎ ভাই আমাদের উপর অত্যাচার করত। যেমন, সে সেফ্টি বুট পরত এবং সেই বুট পরেই অনেক বার জেসবিন্দর ও চানিকে লাথি মারত এবং মারধর করত। আমার বয়স ১৮ বছর ছিল, তাই সে জানত, আমার গায়ে যদি সে হাত তোলে, তা হলে আমি পুলিশের কাছে গিয়ে রিপোর্ট করতে পারি। কিন্তু আমার বোনেরা ছোটো ছিল, তাই সে মনে করত, তাদের প্রতি সে যা ইচ্ছা, তা-ই করতে পারে। একবার সে বাইবেল খোলে এবং সেটিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। তারপর, সে সেটা তাদের মুখের সামনে নিয়ে এসে বলে, “তোমাদের যিহোবাকে বলো, তিনি যেন এই আগুন নিভিয়ে দেন।” সেইসময় পর্যন্ত আমরা লুকিয়ে-চুরিয়ে একটা বা দুটো সভায় যোগ দিয়েছিলাম। কিন্তু, আমাদের সত্য ঈশ্বর যিহোবার উপাসনা করার খুব ইচ্ছা ছিল। তবে এমনটা কর আমাদের পক্ষে অসম্ভব বলে মনে হয়েছিল। সেইজন্য, আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, আমরা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাব এবং অন্য কোথাও গিয়ে থাকব। আসুন আপনাদের বলি, কীভাবে আমরা তা করেছিলাম।
স্কুলের টিফিনের এবং বাসে করে যাওয়ার জন্য আমরা যে-হাত খরচ পেতাম, সেটা আমরা লুকিয়ে রাখতাম। সাধারণত, আমি যা রোজগার করতাম, সেটা নিয়ে আমার সৎ মাকে দিয়ে দিতাম, কিন্তু সেখান থেকেও আমি কিছু টাকা নিজের জন্য আলাদা করে রাখতাম। এরপর আমার তিনটে স্যুটকেস কিনি এবং সেগুলো বাড়ি থেকে দূরে একটা জায়গায় লুকিয়ে রাখি। ধীরে ধীরে আমরা সেটার মধ্যে আমাদের জামাকাপড় ভরতে শুরু করি। ১৯৭২ সালে মে মাসে জেসবিন্দরের বয়স ১৮ বছর হয়ে গিয়েছিল। সেইসময়ের মধ্যে আমরা ১০০ পাউণ্ড (প্রায় ২,০০০ টাকা) জমিয়ে ফেলে ছিলাম। এরপর আমরা একটা ট্রেনে চেপে ইংল্যাণ্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম এলাকায় অবস্থিত পেনজান্স শহরে চলে যাই। সেখানে পৌঁছে আমরা একটা ফোন বুথ থেকে কিছু সাক্ষিকে ফোন করি। ভাইয়েরা খুবই প্রেমের সঙ্গে আমাদের স্বাগত জানায়। এরপর, আমরা কিছু ছোটোখানো কাজ করতে শুরু করি। যেমন, মাছ কেটে পরিষ্কার করা এবং এইরমকই কিছু কাজ করি, যাতে আমরা একটা ঘর ভাড়া করতে পারি এবং নিজেদের ভরণ-পোষণ জোগাতে পারি।
আমরা এক বয়স্ক দম্পতির সঙ্গে আবারও বাইবেল অধ্যয়ন শুরু করি। তাদের নাম ছিল হ্যারি ও বেট্টি ব্রিগস। তারপর ১৯৭২ সালে ট্রুরো কিংডম হলের স্টেজের নীচে একটা ছোটো পুলে আমরা বাপ্তিস্ম নিই। আমাদের পরিবারের লোকেরা তখনও কেউই জানত না যে, আমরা কোথায় আছি। বাপ্তিস্মের পর চানি অগ্রগামীর সেবা শুরু করে এবং আমি ও জেসবিন্দর চাকরি করে সংসার চালাতে থাকি।
বেশি প্রয়োজন রয়েছে এমন জায়গায় গিয়ে সেবা শুরু করি
হ্যারি ও বেট্টির বয়স প্রায় ৯০-এর কাছাকাছি ছিল, কিন্তু তারপরও তারা মাঝেমধ্যে ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলের সিলি দীপপুঞ্জে প্রচার করতে যেতেন। তাদের উদ্যোগ দেখে আমাদেরও সেইরকম কিছু করার উদ্যোগ বেড়ে যায়। তারপর, ১৯৭৩ সালে ভাই স্কিনারের সঙ্গে আমাদের দেখা হয়, যার বিষয়ে আমি প্রথমে বলেছিলাম। তার সঙ্গে আলোচনা করার পর বুঝতে পারি যে, আমাদের কোথায় যাওয়া উচিত।
১৯৭৪ সালের জানুয়ারি মাসে ভারতের নিউ দিল্লি শহরে যাওয়ার জন্য টিকিট কাটি এবং সেখানে চলে যাই। সেখানে আমার ভাই ডিক কটরিলের সঙ্গে দেখা হয় আর কিছু সময় ধরে তার সঙ্গে মিশনারি হোমে থাকার সুযোগ পাই। চানি অগ্রগামীর সেবা করে চলেছিল এবং আমি ও জেসবিন্দর প্রচারে আরও বেশি সময় ব্যয় করতে থাকি।
কিছু সময় পর আমাদের পাঞ্জাবে যাওয়ার জন্য বলা হয়। সেখানে কিছু সময়ের জন্য চণ্ডীগড়ের এক মিশনারি হোমে থাকি। এরপর আমরা একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিই। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি অগ্রগামীর সেবা শুরু করি। আর তারপর ১৯৭৫ সালে আমি বিশেষ অগ্রগামী হিসেবে সেবার করার জন্য আমন্ত্রণ পাই। প্রচার করার ফলে আমি বুঝতে পারি, পাঞ্জাবি ভাষায় কত বেশি প্রকাশনার প্রয়োজন রয়েছে, যাতে বেশিরভাগ লোক জানতে পারে যে, যিহোবা আমাদের কত ভালোবাসেন এবং সবসময় ন্যায়বিচার করেন। ১৯৭৬ সালে ভারতের শাখা অফিস আমাদের তিন জনকে বলে, আমরা যেন পাঞ্জাবি ভাষায় প্রকাশনা অনুবাদ করার কাজে সাহায্য করি। সেইসময়ে টাইপরাইটার ও কম্পিউটার ছিল না, তাই এই কাজ করা সহজ ছিল না। আমরা হাত দিয়ে লিখতাম, তারপর চেকিং ও প্রুফরিডিং করতাম, যাতে দেখতে পারি, কোথাও কোনো ভুল না হয়। তারপর আমরা একজন প্রিন্টারের কাছে যেতাম, যার কাছে পুরোনো আমলের একটা ছাপানোর মেশিন ছিল আর আমরা একসঙ্গে বসে প্রতিটা অক্ষর সঠিক জায়গায় বসাতাম।
ভারতে পাঞ্জাবের চণ্ডীগড় শহরে আমাদের মণ্ডলী
স্বাস্থ্যগত সমস্যা থাকা সত্ত্বেও আনন্দের সঙ্গে সেবা চালিয়ে যাই
সব কিছু খুব দ্রুত পালটে যায়। জেসবিন্দরের সঙ্গে একজন ভাইয়ের দেখা হয়। কিছু সময় পর তাদের বিয়ে হয়ে যায় এবং তারা কানাডা দিয়ে থাকতে শুরু করে। চানিও আমেরিকায় থাকা একজন ভাইকে বিয়ে করে, যাদের পরিবার জার্মানিতে ছিল। তারা দু-জন আমেরিকায় গিয়ে থাকতে শুরু করে। এরই মধ্যে আমার শরীর খুব খারাপ হয়ে যায় এবং ১৯৭৬ সালের অক্টোবর মাসে আমিও ইংল্যান্ডে চলে আসি। সেইসময় আমার মা ও আপন ভাই লেস্টার শহরে থাকত। তারা আমাদের বিরোধিতা করত না এবং তারা বলে, চাইলে আমি তাদের সঙ্গে থাকতে পারি। ডাক্তার আমাকে বলে, আমার ইভান্স সিনড্রোম হয়েছে (এটা রক্তের একটা রোগ, যেটা খুবই কম লোকের মধ্যে দেখা যায় আর এতে শরীর নিজেরই ভালো কোষগুলো নষ্ট করে দেয়)। আমাকে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা করাতে হয় আর এমনকী আমার শরীর থেকে প্লীহা (স্প্লীন) বের করতে হয়। আমাকে অগ্রগামীর সেবাও ছাড়তে হয়।
আমি মন থেকে যিহোবার কাছে প্রার্থনা করি এবং তাঁকে বলি, আমি যদি সুস্থ হয়ে যাই, তা হলে আমি আবারও পূর্ণ সময়ের সেবা শুরু করে দেব। আর আমি এমনটাই করি। যদিও আমার মাঝে মাঝে শরীর খারাপ হত, কিন্তু ১৯৭৮ সালে ওয়ালভারহ্যাম্পটন নামে একটা এলাকায় দিয়ে থাকতে শুরু করি। সেখানে পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বলে এমন অনেক লোক থাকে এবং আমি সেখানে অগ্রগামীর সেবা শুরু করি। আমরা হাত দিয়ে আমন্ত্রণপত্র তৈরি করতাম এবং পরে সেটার ফটোকপি বের করতাম। এরপর, আমরা সেগুলো পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বলে এমন লোকদের দিতাম আর তাদের জনসাধারণ্যের উদ্দেশে বক্তৃতার জন্য আমন্ত্রণ জানাতাম। আজ ব্রিটেনে পাঁচটা পাঞ্জাবি মণ্ডলী এবং তিনটে দল রয়েছে।
ব্রিটেন শাখা অফিস জানত যে, আমি ভারতের পাঞ্জাবি ভাষার অনুবাদ কাজে সাহায্য করতাম। তাই, ১৯৯০ সালের দিকে ব্রিটেন শাখা অফিস আমাকে জিজ্ঞেস করে, আমি আবারও এই কাজে সাহায্য করতে পারি কি না। আমি সপ্তাহে কয়েক দিন বেথেলে যেতে শুরু করি এবং গুরমুখী লিপির অক্ষরের ফন্ট এবং সফট্ওয়ার তৈরি করার কাজে সাহায্যে করি। সেইসময় আমি চাকরি করতাম এবং আমার মায়ের দেখাশোনা করতাম, যিনি আমার কাছ থেকে কিছুটা দূরে থাকত। একইসঙ্গে আমি বেথেলে গিয়েও সেবা করতাম। সব দিক সামলানো যদিও একটু কঠিন ছিল, তবে আমি বেথেলে সেবা করার সুযোগ পেয়ে খুবই খুশি হয়েছিলাম।
১৯৯০ সালের দিকে লন্ডন বেথেলে পাওয়া প্রশিক্ষণ
১৯৯১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমি বেথেল পরিবারের সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ পাই। আমাকে বাইবেলভিত্তিক প্রকাশনাগুলো পাঞ্জাবি ভাষায় অনুবাদ করতে বলা হয়। এটা এমন একটা আশীর্বাদ ছিল, যেটা আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি। আমার মনে হয়েছিল, আমি এই কাজ করার যোগ্য নই এবং আমি প্রায়ই অসুস্থ থাকতাম। এ ছাড়া, বেথেলে সেবা করার বয়স আমার পেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তবুও যিহোবা আমাকে এই আশীর্বাদ করেছিলেন। যদিও বেথেলে সেবা করে আমি খুব খুশি ছিলাম, কিন্তু আমার অসুখ আমাকে ছাড়ছিল না। কেমোথেরাপি এবং অন্যান্য চিকিৎসার কারণে আমার উপর প্রায়ই রক্ত নেওয়ার চাপ আসত। কিন্তু, রক্ত না নেওয়া সত্ত্বেও আমি যেভাবে সুস্থ হয়ে উঠছিলাম, তা দেখে ডাক্তার অবাক হয়ে গিয়েছিল। সেই ডাক্তার আমাকে লন্ডনের একটা নামকরা হাসপাতালের একটা সেমিনারে আমন্ত্রণ জানায়, যেখানে প্রায় ৪০জন ডাক্তার উপস্থিত ছিল। সেখানে আমি প্রায় ১০ মিনিট ধরে সবাইকে বলি যে, কেন আমি রক্ত না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এরপর, লোকেরা এই বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করে এবং আমাদের একজন ভাই, যিনি হসপিটাল ইনফরমেশন ডেস্ক-এ সেবা করতেন, তিনি তাদের প্রশ্নগুলোর উত্তর দেন।
এই কঠিন পরিস্থিতি চলাকালীন আমার বোন জেসবিন্দরের ও চানি আমাকে সাহায্য করে আর তারা আমাকে সামলায়। বেথেলের ভাই-বোনেরা এবং অন্য বন্ধুরা যেভাবে আমার পাশে ছিল, সেটার জন্য আমি তাদের উপর খুবই কৃতজ্ঞ। আমার জীবনের কঠিন সময়ে যিহোবা সবসময় আমাকে শক্তি দিয়েছেন আর এর ফলেই আমি তাঁর কাছ থেকে পাওয়া দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি।—গীতসংহিতা ৭৩:২৬.
যিহোবার আশীর্বাদই ধনী করে তোলে
৩৩ বছর ধরে আমি বেথেলে সেবা করছি। এই সময়ে মধ্যে আমি ‘চেখে দেখি, যিহোবা কত ভালো।’ (গীতসংহিতা ৩৪:৮; হিতোপদেশ ১০:২২) অন্য বিশ্বস্ত বয়স্ক ভাই-বোনদের উদাহরণ থেকেও আমি অনেক উৎসাহ লাভ করি। আমি যখন পুরোনো দিনের কথা মনে করি, তখন আমি এই বিষয়ে খুশি হই যে, পাঞ্জাবি ভাষায় কথা বলে এমন অনেক আমার বাইবেল ছাত্রী বিশ্বস্তভাবে যিহোবার সেবা করছে। আমার পরিবারের সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক রয়েছে। মা ও ভাই যদিও যিহোবার সাক্ষি নয়, তবে মা প্রায়ই আমাকে বলে, “তুমি সত্যিই ঈশ্বরকে ভয় কর।” আমি যখন নিজের ভাইকে বলি যে, বেথেল ছেড়ে আমি মায়ের দেখাশোনা করার জন্য প্রস্তুত আছি, তখন সে আমাকে বলে, “তুমি অনেক ভালো কাজ করছ, আর সেটাই করে যাও।” আমার মা বেথেল থেকে অনেক দূরে একটা নার্সিং হোমে থাকে, যেখানে তার ভালো করে যত্ন নেওয়া হয়। কিন্তু, প্রায়ই আমি তার সঙ্গে দেখা করতে সেখানে যাই।
আমার জীবনে যখনই কোনো সমস্যা এসেছিল, তখন আমি নিজেকে বলতাম, ‘কোমাল, ভয় পেয়ো না। যিহোবা তোমার ঢাল। তিনি তোমাকে অনেক বড়ো পুরস্কার দেবেন।’ (আদিপুস্তক ১৫:১) আমি “ন্যায়বিচারের ঈশ্বর” যিহোবাকে ধন্যবাদ দিতে চাই যে, আমি যখন খুব ছোটো ছিলাম, তখন থেকেই তিনি আমার উপর লক্ষ রেখেছিলেন এবং তিনি আমাকে অনেক অসাধারণ কাজ করার সুযোগ দিয়েছিলেন। (যিশাইয় ৩০:১৮) আমি সেই দিনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছি, যখন “কোনো বাসিন্দা বলবে না: ‘আমি অসুস্থ।’”—যিশাইয় ৩৩:২৪.
চেমস্ফোর্ড বেথেলে