আমার বাবা “পারমাণবিক বোমার দ্বারা জেল থেকে মুক্ত হয়েছিলেন”
আগস্ট ৬, ১৯৪৫ সালে সকাল ৮:১৫ মিনিটে একটি পরমাণু বোমা জাপানের হিরোশিমাতে বিস্ফোরিত হয়, ফলে শহর ধ্বংস হয়ে হাজার হাজার ব্যক্তি প্রাণ হারায়। আমার বাবা সম্রাটকে উপাসনা এবং জাপানের মিলিটারিকে সর্মথন না করার ফলে তখন তিনি হিরোশিমার জেলে বন্দী ছিলেন।
বাবা অনেকবার সেই স্মরণীয় সকালটি সম্বন্ধে বলেন। “আমার জেলের ছাদে আলো চমকালো,” তিনি বলেন। “তারপরে আমি খুব জোরে গর্জন শুনলাম যেন একসঙ্গে সব পাহাড় পড়ে গেছে। তৎক্ষণাৎ জেলের ঘরটি কালো অন্ধকারে ভরে গেল। আমি আমার মাথা গদির তলায় লুকালাম যাতে সেই কালো গ্যাস থেকে রক্ষা পেতে পারি।
“সাত কিংবা আট মিনিট পরে আমি গদির তলা থেকে মাথা বার করে দেখলাম যে ‘গ্যাস’ আর নেই। আবার আলো হয়েছে। তাকের জিনিসগুলি এবং অনেকখানি ধূলো পড়ে আর্বজ্জনা সৃষ্টি করেছিল। জেলের চারিপাশে উঁচু দেওয়াল থাকার ফলে বাইরের আগুন আসতে পারেনি।
“আমি পিছনের জানলা দিয়ে দেখলাম এবং অবাক হলাম! জেলের কারখানাগুলি এবং কাঠের ঘরগুলি সব ধুলিসাৎ হয়ে গেছে। তারপরে আমি সামনের ছোট জানলা দিয়ে দেখলাম, আমার সামনের জেলের ঘরগুলি সব ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। যে কয়েদিরা বেঁচে ছিল তারা সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিল। ভয় এবং আতঙ্ক—পুরোপুরি গোলমাল আর সেটি ভয়াভয় দৃশ্য ছিল।”
ছোটবেলায় বাবার কাছ থেকে শুনে শিহরিত হতাম যখন তিনি বলতেন “পারমাণবিক-বোমার দ্বারা জেল থেকে মুক্ত হয়েছিলাম।” তিনি এই গল্পটি কোন অপরাধ বোধ না করেই বলতেন কারণ তাকে অন্যায়ভাবে বন্দী করা হয়েছিল। আমার বাবার বিরুদ্ধে অপরাধ এবং জেলেতে থাকাকালীন পরিস্থিতি বর্ণনা করার আগে, আসুন আমি আপনাদের বলি কিভাবে আমার পিতামাতা টোডিশার সংস্পর্শে আসে, তখনকার দিনে জাপানে ওয়াচ টাওয়ার বাইবেল আ্যণ্ড ট্র্যাক্ট সোসাইটিকে যা বলে ডাকা হত।
উদ্দেশ্যর অন্বেষণ
বাবা খুব বই ভালবাসতেন এবং ছোটবেলা থেকে তিনি পড়াশুনা করে তার জীবনের পরিস্থিতি উন্নতি করার চেষ্টা করেছিলেন। উত্তর-পূর্ব জাপানের ইশিনোমোরি শহরে যখন তিনি প্রাথমিক বিদ্যালয়েতে মাত্র পঞ্চম শ্রেণীতে পড়তেন তখন তিনি ঘর ছেড়ে পালিয়ে যান। শুধু একমুখো টিকিটের ভাড়া নিয়ে তিনি ট্রেনে করে টোকিওর দিকে রওনা দিলেন, যেখানে তিনি শিগেনোবু ওকুমা যিনি দুইবার জাপানের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন তার ঘরে পরিচারক হিসাবে কাজ করবেন বলে ঠিক করেছিলেন। কিন্তু যখন এই জীর্ণ কাপড় পরা গ্রামের ছেলে শ্রী. ওকুমার বাড়িতে যান, তখন তার কাজের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করা হয়। পরে বাবা দুধের দোকানে থাকতে পান ও সেখানে কাজও পান।
কিশোর অবস্থা থেকেই আমার বাবা রাজনীতিবিদ্ এবং পণ্ডিতদের বক্তৃতায় যোগদান করতেন। একটি বক্তৃতায় বলা হয়েছিল যে বাইবেল হল গুরত্বপূর্ণ বই। তাই সম্পূর্ণ ক্রস-রেফেরেনস্ এবং বাইবেল মানচিত্রাবলী সহ আমার বাবা একটি বাইবেল ক্রয় করেন। তিনি যা পড়েন তা তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে এবং সমগ্র মানবজাতির ভালোর জন্য কাজ করতে প্রেরণা পান। অবশেষে বাবা বাড়ি ফিরে আসেন ২৪ বছর বয়সে ১৯৩১ সালের এপ্রিল মাসে এবং ১৭ বছর বয়সী হাজিনোকে বিবাহ করেন। বাবার বিবাহ হওয়ার অল্প কিছুদিন পরে, এক আত্মীয় টোডিশা দ্বারা প্রকাশিত সাহিত্য দেন। যা তিনি পড়েন তার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে বাবা টোকিওর টোডিশাতে লেখেন। জুন মাসে ১৯৩১ সালে মাতসুই ইশি নামে একজন পূর্ণ সময়ের পরিচারক তার সাথে দেখা করতে সেনডাই থেকে ইশিনোমোরিতে আসেন।a বাবা তার কাছ থেকে কয়েকটি বই গ্রহণ করেন যার অন্তর্ভুক্ত ছিল ঈশ্বরের বীণা, সৃষ্টি এবং সরকার (ইংরাজি)।
a মাতসুই ইশির জীবন কাহিনী জানার জন্য দয়া করে মে ১, ১৯৮৮ সালের প্রহরীদুর্গ-এর ২১-৫ পৃষ্ঠা দেখুন।
জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে বার করা
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বাবা বুঝতে পারলেন যে গির্জার বিভিন্ন শিক্ষাগুলি, যে মানুষের আত্মা অমর, দুষ্টেরা চিরদিন নরকে জ্বলতে থাকে, সৃষ্টিকর্তা একের মধ্যে তিন ঈশ্বর, সেই সবই মিথ্যা। (উপদেশক ৯:৫, ১০; যিহিষ্কেল ১৮:৪; যোহন ১৪:২৮) তিনি এও বুঝতে পেরেছিলেন যে এই জগতের ধ্বংস হবে। (১ যোহন ২:১৭) এই বিষয়ে কি করতে হবে জানবার জন্য তিনি টোডিশার প্রতিনিধির সঙ্গে যোগাযোগ করলেন। তিনি আগস্ট ৩১, ১৯৩১ সালে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাদের কথোপকথনের ফলে, বাবা বাপ্তিস্ম গ্রহণ করেন এবং সিদ্ধান্ত নেন যিহোবার পূর্ণ সময়ের প্রচারক হবেন।
দীর্ঘ সময় আলোচনা করার পরে, মা বুঝতে পারলেন যে বাইবেল থেকে যা কিছু শিখেছেন তা হল সত্য। তিনি উৎসর্গীকরণ করেন এবং অক্টোবর ১৯৩১ সালে বাপ্তিস্ম নেন। যখন আমার বাবা তার জমি নিলামের জন্য দেন তার আত্মীয়রা ভাবে যে তিনি পাগল হয়ে গেছেন।
পূর্ণ সময়ের প্রচারক হিসাবে জীবন
বাবা নিলামের পুরো টাকা তার মায়ের নামে করে দিয়ে, বাবা এবং আমার মা ১৯৩১ সালে নভেম্বরে টোকিওতে চলে যান। লোকেদের সঙ্গে রাজ্যের সুসমাচারের বিষয়ে কিভাবে কথা বলতে হবে সেই বিষয়ে কোন নিদের্শাবলী না পাওয়া সত্ত্বেও, যে দিনে তারা সেখানে পৌঁছান সেই দিন থেকে তারা প্রচার করতে শুরু করে দেন।—মথি ২৪:১৪.
তাদের জীবন সহজ ছিল না। বিশেষকরে আমার মায়ের জন্য এই জীবন কঠিন ছিল, যিনি তখন মাত্র ১৭ বছরের ছিলেন। সেখানে কোন সহ সাক্ষীরা ছিল না, কোন সভা ছিল না আর কোন মণ্ডলীও ছিল না—শুধুমাত্র সকাল ৯-টা থেকে বিকাল ৪-টে পর্যন্ত ঘরে ঘরে বাইবেল সাহিত্য বিতরণের দৈনন্দিন তালিকা।
১৯৩৩ সালে তাদের প্রচার কাজের দায়িত্ব টোকিও থেকে কোব-এ পরিবর্তন করে দেওয়া হয়। ফেব্রুয়ারি ৯, ১৯৩৪ সালে সেখানে আমি জন্মগ্রহণ করি। আমার মা আমার জন্মের এক মাস আগে পর্যন্ত উদ্দীপনার সাথে প্রচার কাজ করেন। পরে আমার বাবামা ইয়ামাগুচি থেকে উব, কুর এবং অবশেষে হিরোশিমায় যান এবং প্রত্যেকটি জায়গায় এক বছর করে প্রচার করেন।
আমার বাবামাকে গ্রেপ্তার করা হয়
যত জাপানের সৈন্যবাহিনীর কাজকর্ম বাড়তে থাকে ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির প্রকাশনাগুলি নিষিদ্ধ করা হয় এবং বিশেষ গুপ্ত পুলিশ সেবার দ্বারা সাক্ষীদের উপর কড়া নজর রাখা হয়। তারপরে, জুন ২১, ১৯৩৯ সালে সারা জাপানে যিহোবা সাক্ষীদের পূর্ণ সময়ের প্রচারকদের গ্রেপ্তার করা হয়। আমার বাবা এবং মা তাদের মধ্যে ছিলেন। আমার ঠাকুমার তত্ত্বাবধানে আমাকে ইশিনোমোরিতে রাখা হল। আট মাস বন্দী অবস্থায় থাকার পর আমার মাকে ছাড়া হল এবং কড়া নজরে রাখা হল এবং অবশেষে ১৯৪২ সালে সেন্ডাইতে তার সাথে আমি মিলিত হতে পেরেছিলাম।
ইতিমধ্যে, অন্য সাক্ষীদের সাথে বাবাকে গুপ্ত পুলিশ হিরোশিমা পুলিশ স্টেশনে জেরা করতে থাকে। সম্রাটকে উপাসনা অথবা জাপানের সামরিকবাহিনীকে সমর্থন করতে অস্বীকার করায় সাক্ষীদের খুব কঠোরভাবে মারা হয়। জিজ্ঞাসক বাবাকে যিহোবার উপাসনা করা থেকে রুখতে পারেনি।
দুই বছরের বেশি বন্দী থাকার পর, বাবাকে আদালতে নিয়ে আসা হল। এইরকম একটি দিনে ন্যায়াধীশ জিজ্ঞাসা করলেন: “মিউরা, রাজাধিরাজ, সম্রাট সম্বন্ধে তোমার কী ধারণা?”
রাজাধিরাজ, সম্রাট হলেন আদমের বংশধর এবং মরণশীল, অসিদ্ধ মানব,” বাবা উত্তর দিলেন। এই কথা শুনে আদালতের রিপোর্টার এত অবাক হলেন যে তা তিনি লিখতে ব্যর্থ হন। কারণ, বেশির ভাগ জাপানিরা মনে করত যে সম্রাট হলেন ঈশ্বর। বাবার পাঁচ বছর জেল হল এবং ন্যায়াধীশ বললেন যে, যদি তিনি তার বিশ্বাস ছেড়ে না দেন তাহলে তিনি হয়ত আজীবন কারাবন্দী থাকবেন।
কিছু দিন পরে ১৯৪১ সালে ডিসেম্বরে, পার্ল হার্বারে হাওয়াইতে যুক্তরাষ্ট্রকে জাপান আক্রমণ করে। জেলে খাবার কমে যায়, এবং শীতের সময়ে কাপড়ের অভাব ছিল বলে বাবার ঠাণ্ডায়, অনিদ্রায় অনেক রাত কেটেছে। আধ্যাত্মিক মেলামেশা থেকে সম্পূর্ণভাবে বিচ্ছিন্ন থাকলেও, তিনি জেলের গ্রন্থাগারের বাইবেল পড়তে পারতেন এবং সেটি বার বার পড়ে তিনি তার আধ্যাত্মিক শক্তি বজায় রাখতে পেরেছিলেন।
যখন বোমাটি পড়ে
আগস্ট ৬, ১৯৪৫ সালে ভোরবেলায় একজন কয়েদি বাবার সঙ্গে বই বদলাতে আসে। তা করা নিষিদ্ধ ছিল, যেহেতু কয়েদি ততক্ষণে বইটি হলেতে দিয়ে দিয়েছিল তাই বাবা তার বইটি অন্য কয়েদির ঘরেতে ঢুকিয়ে দেন। ফলে যখন বোমা পড়ে তিনি তার কঠোর তালিকা অনুকরণ না করে তিনি সেইদিন বই পড়ছিলেন। সাধারণত সকালের সেই সময়টিতে তিনি হয়ত শৌচালয়ে থাকতেন। বোমা পড়ার পরে বাবা দেখলেন যে পড়ে যাওয়া ভগ্নাবশেষের দ্বারা শৌচালয়ের এলাকা ধ্বংস হয়ে গেছে।
তারপর বাবাকে কাছাকাছি ইয়াকুনি জেলে নিয়ে যাওয়া হয়। এর কিছুদিন পরেই জাপান যৌথ শক্তির কাছে সমর্পণ করে, এবং যুদ্ধের পরে গণ্ডগোলের মধ্যে তাকে জেল থেকে ডিসেম্বর ১৯৪৫ সালে মুক্ত করা হয়। তার স্বাস্থ্য সম্পূর্ণ ভেঙ্গে গিয়েছিল। তার বয়স শুধুমাত্র ৩৮ ছিল, কিন্তু তাকে বয়স্ক ব্যক্তির মত দেখাচ্ছিল। প্রথমে, আমি বিশ্বাস করতে পারিনি যে তিনি আমার বাবা।
তার বিশ্বাস তখনও দৃঢ় ছিল
জাপান গণ্ডগোলের মধ্যে ছিল এবং অবশিষ্ট কিছু সাক্ষীরা কোথায় ছড়িয়ে ছিল আমরা জানতাম না। আমাদের কাছে যিহোবা সাক্ষীদের কোন সাহিত্যাদিও ছিল না। তবুও, বাবা আমাকে সরাসরি বাইবেল থেকে যিহোবার রাজ্য সম্বন্ধে সত্য, নতুন জগৎ এবং আসন্ন হর্মাগিদোনের যুদ্ধ সম্বন্ধে শিখিয়েছিলেন।—গীতসংহিতা ৩৭:৯-১১, ২৯; যিশাইয় ৯:৬, ৭; ১১:৬-৯; ৬৫:১৭, ২১-২৪; দানিয়েল ২:৪৪; মথি ৬:৯, ১০.
পরে যখন উচ্চ বিদ্যালয়ে ক্রমবিবর্তনবাদ সম্বন্ধে শিক্ষা দেওয়া হয়, তখন আমি ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ করতে শুরু করি, বাবা আমাকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে তা বুঝাবার চেষ্টা করেন। যখন আমি বিশ্বাস করতে ইতস্তত করি, তিনি অবশেষে বলেন: “জগতের বেশির ভাগ লোকেরা যুদ্ধকে সমর্থন করে এবং রক্তপাতের দোষে দোষি হয়। আমি বাইবেলের সত্যকে ধরে রাখি এবং কখনও সৈন্যবাহিনী, সম্রাট উপাসনা কিংবা যুদ্ধকে সমর্থন করিনি। তাহলে ভাল করে চিন্তা কর কোন্টি জীবনের সঠিক পথ যাতে তোমার চলা উচিত।”
বাবা যা শিক্ষা দিয়েছিলেন এবং যেভাবে তিনি চলছিলেন তার সঙ্গে আমি স্কুলেতে যা শিখছিলাম, তার তুলনা করে আমি বুঝতে পারলাম যে ক্রমবিবর্তনবাদ সঠিক চিন্তাধারা নয়। যদিও কোন ক্রমবিবর্তনে বিশ্বাসী লোকেরা তাদের বিশ্বাসের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতে রাজি ছিল না কিন্তু বাবা তার বিশ্বাসের জন্য মরতেও রাজি ছিলেন।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পাঁচ বছর বাদে একদিন ১৯৫১ সালের মার্চ মাসে, বাবা আসাহি সংবাদপত্র পড়ছিলেন। হঠাৎ তিনি চিৎকার করে উঠলেন “তারা এসে গেছে, তারা এসে গেছে!” তিনি সংবাদপত্রটি আমাকে দেখালেন। যিহোবার সাক্ষীদের পাঁচজন মিশনারী সম্বন্ধে প্রবন্ধটি ছিল যারা সম্প্রতি ওসাকাতে আসেন। আনন্দের সঙ্গে তিনি সংবাদপত্রের সাথে যোগাযোগ করেন এবং জানতে পারলেন যে যিহোবার সাক্ষীরা টোকিওতে শাখা দপ্তর খুলেছেন। তিনি ঠিকানা নেন এবং শাখা দপ্তরে যান, ফলে যিহোবার সাক্ষীদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ স্থাপন হল।
শেষ পর্যন্ত বিশ্বাসী
১৯৫২ সালে আমাদের পরিবার সেনডাইতে চলে যায়। ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির মিশনারী ডোনাল্ড এবং মেবেল হাসলেট সেই বছরে সেখানে আসেন এবং ঘর ভাড়া নেন প্রহরীদুর্গ পাঠ নেওয়ার জন্য। প্রথমে শুধু চারজন আসে—হাসলেটরা, আমার বাবা এবং পরে আমি। পরে শিনিচি এবং মাসাকো তোহারা, এডেলিন নেকো, এবং লিলিয়ান সামসন্ হাসলেটদের সঙ্গে সেনডাইতে মিশনারী কার্যে যোগদান করেন।
এই মিশনারীদের সঙ্গে মেলামেশার সঙ্গে আমাদের পরিবার ঈশ্বরের বাক্য এবং সংগঠনের জ্ঞানে বাড়তে থাকে। যুদ্ধকালীন সময়ে যে ঘটনাগুলি ঘটেছিল তা দেখে মায়ের বিশ্বাস টলে গিয়েছিল কিন্তু, খুব তাড়াতাড়ি তিনি আমাদের সাথে সভাতে এবং ক্ষেত্র পরিচর্যায় যোগদান করতে শুরু করেন। যিহোবাকে সেবা করার জন্য আমার জীবনকে উৎসর্গ করতে আমি অনুপ্রাণিত হই এবং আমি এপ্রিল ১৮, ১৯৫৩ সালে বাপ্তিস্মিত হই।
যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বাবা বীমা কোম্পানিতে সেলস্ম্যানের কাজ করেন। বন্দীদশার পরিণামের অন্তর্ভুক্ত বৃক্ক গণ্ডগোল এবং উচ্চ রক্তচাপ থাকা সত্ত্বেও, অগ্রগামী হিসাবে পূর্ণ সময় পরিচর্যা কাজ পুনরায় শুরু করতে তার অত্যন্ত ইচ্ছা ছিল। তিনি তা করেন প্রায় একই সময়ে যখন আমি বাপ্তিস্মিত হই। যদিও ভগ্ন স্বাস্থ্য তাকে তা বেশিদিন অগ্রগামী হিসাবে কাজ করতে দেয়নি, পরিচর্যার প্রতি তার উদ্যোগ আমাকে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যোগদান করছিলাম ছাড়তে প্রেরণা দেয় এবং পূর্ণ সময়ে পরিচর্যা কাজ হিসাবে নিতে সাহায্য করে।
নাগোয়া থেকে এক উত্তম যুবক ইসামু সুগিউরাকে আমার অগ্রগামী সঙ্গী হিসাবে নিযুক্ত করা হয়। মে ১, ১৯৫৫ সালে আমরা বিশেষ অগ্রগামী হিসাবে কিউশু দ্বীপের বেপ্পুতে পরিচর্যা শুরু করি। সম্পূর্ণ দ্বীপপুঞ্জে তখন শুধু কয়েকজন সাক্ষী ছিল। এখন ৩৯ বছর বাদে সেখানে আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে সমৃদ্ধশালী ১৫টি সীমা রয়েছে এবং সেই দ্বীপে ১৮,০০০ বেশি সাক্ষীরা রয়েছে। আর সম্পূর্ণ জাপানে এখন প্রায় ২,০০,০০০ জন সাক্ষী রয়েছে।
ইসামু ও আমি ১৯৫৬ সালের বসন্তকালে ওয়াচ টাওয়ার বাইবেল স্কুল অফ গিলিয়েডে যোগদান করতে যুক্তরাষ্ট্রে আমন্ত্রণ পাই। আমরা অত্যন্ত খুশি হই। কিন্তু, যাওয়ার জন্য যখন আমার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয় ডাক্তাররা যক্ষ্মারোগ খুঁজে পান। অত্যন্ত নিরাশ হয়ে আমি সেনডাইতে ফিরে যাই।
ইতিমধ্যে বাবার দৈহিক স্বাস্থ্য আরও খারাপ হয়ে গেছিল এবং তিনি বাড়িতে খাটে শুয়েছিলেন। আমাদের ভাড়া করা ঘর নয় বর্গ মিটারের একটি ঘর ছিল এবং মেজে টাটামি মাদুর দিয়ে ঢাকা ছিল। আমি এবং আমার বাবা পাশাপাশি শুয়েছিলাম। যেহেতু বাবা কাজ করতে পারছিলেন না, মাকে আর্থিক চাহিদা মিটাতে খুব কষ্ট করতে হয়।
জানুয়ারি ১৯৫৭ সালে ফ্রেডরিক্ ডাবলু. ফ্রান্স, ওয়াচ টাওয়ার সোসাইটির তৎকালীন উপসভাপতি জাপানে আসেন এবং একটি বিশেষ সম্মেলন কিয়োটোতে আয়োজন করা হয়। মাকে যোগদান করতে বাবা উৎসাহ দেন। আমাদের রোগগ্রস্ত অবস্থায় ছেড়ে যেতে অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি বাবার কথার বাধ্য হয়ে সম্মেলনের জন্যে চলে যান।
তার কিছুদিন পরে বাবার অবস্থা দিনের পর দিন আরও খারাপ হতে লাগল। পাশাপাশি শুয়ে, আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম এবং তাকে জিজ্ঞাসা করলাম যে আমরা কি করে জীবনযাপন করব। তার উত্তরে তিনি বলেন: “এমনকি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমরা যিহোবাকে সেবা করছি, তিনি হলেন সর্বশক্তিমান ঈশ্বর। তুমি কেন চিন্তা করছ? যিহোবা নিশ্চয় যা আমাদের প্রয়োজন তা তিনি যোগাবেন।” তারপরে তিনি কোমলতার সাথে আমাকে উপদেশ দিলেন: “নিজের মধ্যে আরও দৃঢ় বিশ্বাস গড়ে তোলো।”
মার্চ ২৪, ১৯৫৭ সালে বাবা নি:শব্দে তার শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন। বাবাকে কবর দেওয়ার পর আমি বীমা কোম্পানিতে সবকিছু মিটিয়ে দিতে যাই। যখন আমি চলে আসছিলাম শাখা ম্যানেজার আমাকে একটি কাগজের ব্যাগ দিয়ে বললেন: “এটি তোমার বাবার।”
বাড়িতে এসে দেখি যে তার মধ্যে অনেক টাকা আছে। পরে যখন আমি ম্যানেজারকে জিজ্ঞাসা করি, তিনি বলেন এটি তার অজ্ঞাতে মাসিক বেতন থেকে বীমার জন্য কিছু টাকা কেটে রেখে দেওয়া হত। বাবার কথাগুলি “যিহোবা নিশ্চয় যা আমাদের প্রয়োজন তা তিনি যোগাবেন,” এইভাবে সত্য প্রমাণিত হয়। যিহোবার সুরক্ষিত তত্ত্বাবধানের উপর আমার বিশ্বাস বেড়ে গেল।
বহু দশক ধরে অবিরত সেবা
সেই টাকা সাহায্যের দ্বারা আমি ঘরেতে সুস্থ হওয়ার দিকে মনোযোগ দিতে পেরেছিলাম। এক বছর বাদে ১৯৫৮ সালে মা ও আমাকে বিশেষ অগ্রগামী করে দেওয়া হয়। তারপরে, আমি জাপানে ভ্রমণকারী অধ্যক্ষ হিসাবে কাজ করি এবং ১৯৬১ সালে আমি ব্রুকলিন, নিউ ইয়র্ক-এ যিহোবার সাক্ষীদের বিশ্ব প্রধান দপ্তরে দশ মাসের গিলিয়ড স্কুলে যোগ দেওয়ার সুযোগ পাই।
যখন জাপানে ফিরে আসি, আমি আবার ভ্রমণকারী অধ্যক্ষের কাজ শুরু করে দিই। তারপরে, ১৯৬৩ সালে আমি ইয়াসুকো হাবা, যিনি যিহোবার সাক্ষীদের টোকিওর শাখা দপ্তরে কাজ করছিলেন তাকে বিবাহ করি। সে আমার সঙ্গে ভ্রমণ কাজে যোগদান করে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত, তারপরে আমাদের টোকিও শাখা দপ্তরে কাজ করতে ডাকা হয়। সেই সময় থেকে আমরা এক সঙ্গে কাজ করতে শুরু করি—প্রথমে টোকিওতে, তারপরে নুমাজুতে এবং এখন এবিনাতে।
১৯৬৫ সাল পর্যন্ত মা বিশেষ অগ্রগামীর কাজ চালিয়ে যান। সেই সময় থেকে তিনি সক্রিয় থাকেন এবং অনেককে বাইবেল সত্য সম্বন্ধে শিখতে সাহায্য করেছেন। তার বয়স এখন ৭৯ এবং তিনি তুলনামূলকভাবে সুস্থ। আমরা খুশি যে তিনি কাছাকাছি থাকেন এবং যে মণ্ডলীতে আমরা যাই সেই একই মণ্ডলীতে যোগদান করে, এবিনা শাখা দপ্তরের কাছে।
আমরা যিহোবা ঈশ্বরকে সত্যিই ধন্যবাদ দিই যে আমার বাবাকে হিরোশিমার পারমাণবিক-বোমা থেকে রক্ষা করেছিলেন। তিনি তার বিশ্বাস বজায় রেখেছিলেন এবং এটি আমার ইচ্ছা যে তাকে নতুন জগতে অভিনন্দন জানাব এবং বর্ণনা করব কী করে আমরা হর্মাগিদোন থেকে রক্ষা পেয়েছিলাম, যে যুদ্ধ তার দেখার খুব ইচ্ছা ছিল। (প্রকাশিত বাক্য ১৬:১৪, ১৬; ২১:৩, ৪) সুটোমু মিউরা দ্বারা কথিত। (g94 10/8)
কাটসুয়ো এবং হাজিনো মিউরা তাদের ছেলে সুটোমুর সাথে
সুটোমু মিউরা জাপানের শাখা দপ্তরে কাজ করছেন